পর্ব ৫: “আমার মধ্যেই আমি হারিয়ে যাই”OCD ও Identity Crisis নিয়ে এক শিক্ষকের আত্মসংগ্রাম
পর্ব ৫: “আমার মধ্যেই আমি হারিয়ে যাই”
OCD ও Identity Crisis নিয়ে এক শিক্ষকের আত্মসংগ্রাম
✍️ লিখেছেন: রথীন ঘোষ, ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
(বাস্তব কেসের উপর ভিত্তি করে রচিত, নাম পরিবর্তিত)
১. মুখোমুখি প্রথমবার: যেন নিজেকেই চিনতে পারছি না
“স্যার, আমি নিজেকেই যেন খুঁজে পাই না। কখনও মনে হয়, আমি সেই সোমেন না যে ক্লাসে পড়াই—আমি যেন শুধু একটা মেশিন, যা প্রতিদিন ঠিকঠাক চলার অভিনয় করে।”
এই ছিল তাঁর প্রথম শব্দগুলো।
৪৬ বছর বয়স, সরকারি স্কুলে বাংলা পড়ান।
সোমেন চট্টোপাধ্যায়—যাঁকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা চেনে “অতি নিখুঁত শিক্ষক” হিসেবে।
কিন্তু এই নিখুঁততার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অদৃশ্য, অজানা, অজস্র ভয় আর অপরাধবোধের পাহাড়।
ক্লিনিকে এসে বসার সময় তাঁর মুখে ছিল ক্লান্তির ছাপ, হাতজোড়ে বারবার ঘষা, আর চোখে একরাশ উদ্বেগ।
আমি জানতাম—এই মানুষটির ভিতরে OCD (Obsessive Compulsive Disorder) শুধু একটা রোগ নয়, বরং এটা হয়ে উঠেছে তাঁর পরিচয় সংকটের কেন্দ্রবিন্দু।
২. যখন মনে হয় বারবার হাত ধুলেও কিছু যেন বাকি থাকে
তিনি বলেন—“স্যার, আমি যখন হাত ধুই, তখন একটা অদ্ভুত ভয় হয়—কিছু একটা ভুল হয়ে গেল না তো?
আঙুলটা ভালো করে ঘষলাম তো? সাবানটা কি ঠিক জায়গায় রাখলাম?”
আমি লক্ষ করলাম, এই “সন্দেহ” কোনও বাস্তব জিনিস থেকে নয়—এটা তাঁরই মনের সৃষ্টি, একটা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, যা 'নিয়ন্ত্রণ' না পাওয়া পর্যন্ত থামে না।
এটা হলো OCD-এর এক প্রচলিত রূপ—"Contamination OCD", যেখানে রোগী বারবার পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তবুও মনে হয়, কিছু একটা ঠিক হয়নি।
এই সন্দেহের বৃত্তেই চলছিল সোমেন বাবুর দৈনন্দিন জীবন।
৩. অদ্ভুত চিন্তার ফাঁদ—নিজেকেই ঘৃণা করা শুরু
তবে সবচেয়ে গভীর যে যন্ত্রণা তিনি প্রকাশ করলেন, তা হল—
“স্যার, মাঝে মাঝে মনে হয়… আমি যদি হঠাৎ ছাত্রদের ক্ষতি করে ফেলি? আমি জানি এটা আমি করব না, আমি চাইও না। কিন্তু এই চিন্তা মাথায় এলেই নিজেকে ঘৃণা হয়। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?”
এটি হলো “Intrusive Thought OCD”, যেখানে রোগীর মনে অজান্তেই চলে আসে ভয়ানক, ভীতিকর চিন্তা—যেগুলো তিনি কখনওই বাস্তবে করতে চান না।
এই চিন্তাগুলো এতটাই ঘৃণ্য তাঁর কাছে যে, এগুলোর জন্য নিজেকে শাস্তি দেন। তিনি বলেন—
“মনে হয়, আমি এমন চিন্তা করছি মানে আমি খারাপ মানুষ।”
এই একটা ভাবনাই তাঁকে দিনের পর দিন ভেঙে দিচ্ছিল—কারণ তিনি বুঝতেই পারছিলেন না, তাঁর মনের চিন্তা মানেই তাঁর অস্তিত্ব নয়।
৪. অতীতের রূঢ় ছায়া: বাবার গলার আওয়াজ এখনো কানে বাজে
চতুর্থ সেশনে আমি তাঁকে বললাম—“এই ভয়টা কবে থেকে?”
তিনি একটু চুপ করে থাকলেন, তারপর চোখ সরিয়ে বললেন—
“আমি ছোটবেলায় সবসময় ভুল করার ভয় পেতাম।
বাবা ছিলেন মিলিটারি টাইপ। কড়া শাসন, চিৎকার, গালাগালি—এগুলো ছিল দৈনিক ঘটনা।
একটা গামছা যদি উল্টো ঝুলে, তার জন্যেও মার খেয়েছি।”
তিনি বললেন, সেই সময় থেকেই তাঁর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায়—
“ভুল করলেই আমি খারাপ। নিখুঁত না হলে আমি অযোগ্য।”
এই হলো তাঁর Core Belief—যা পরে তাঁর OCD-এর ইন্ধন জুগিয়েছে।
৫. স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক: যে সম্পর্ক শুধু মুখে টিকে আছে
সোমেন বাবু বিবাহিত। স্ত্রী একজন সরকারি অফিস সহায়িকা।
তাঁর কথায়—
“আমাদের সম্পর্ক টিকে আছে শুধু সমাজের চোখে।
আমি আমার ভিতরের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে পারি না।
সে ভাবে—‘তুমি বেশি ভাবো।’
আমি ভাবতে ভাবতেই তো বাঁচি, ভাবতে ভাবতেই তো মরি।”
OCD-এর সঙ্গে জড়িত লোকজন প্রায়ই এই অভিজ্ঞতা পান—তাঁদের “অতিরিক্ত চিন্তা” বা “শুচিবাই” সমাজ ও পরিবার খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায় না।
এর ফলে জন্ম নেয় একা থাকার বোধ—যা আরও ক্ষত তৈরি করে।
৬. ‘আমি কে?’—এই প্রশ্নটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল
আমি তাঁকে বললাম—“আপনি নিজেকে কিভাবে দেখেন?”
তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বলেন—
“স্যার, আমি জানি না আমি কে!
আমি শিক্ষক? OCD-র রোগী?
না কি বাবা-মায়ের ছোটবেলার রাগ পুষে রাখা পুতুল?”
এখানেই ফুটে ওঠে তাঁর Identity Crisis।
OCD শুধু তাঁর মনের উপসর্গ নয়—এটা তাঁর চেতনার রঙ পাল্টে দিয়েছে।
আমরা শুরু করি:
✅ CBT (Cognitive Behavioral Therapy)
✅ ERP (Exposure and Response Prevention)
✅ Identity Reinforcement Techniques
✅ Inner Child Compassion Therapy
৭. থেরাপির ধাপ: নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা
CBT দিয়ে শুরু: চিন্তার কাঠামো ভাঙা
তাঁর চিন্তাগুলো খতিয়ে দেখি:
“ভুল করলেই মানুষ খারাপ হয়”
“আমি যা ভাবি, সেটাই আমি”
“নিজেকে কষ্ট না দিলে আমি শুদ্ধ হতে পারি না”
আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করি—“কোনো প্রমাণ আছে?”
তাঁর উত্তর নেই।
সেখান থেকেই শুরু “Reality Testing”।
ERP: ভয়কে ভয় না পাওয়া শেখা
একদিন তাঁকে বললাম—
“আজ শুধু একবার দরজা তালা চেক করবেন। আর না।”
প্রথমে আতঙ্ক, কাঁপুনি। কিন্তু তারপর দিন শেষে যখন দেখলেন—সব ঠিক আছে, তখন প্রথম একটা ‘জয়’ অনুভব করলেন।
Self Identity Rebuilding
আমি বলি—“প্রতিদিন লিখুন—‘আমি কে?’”
কিছুদিন পর তিনি বলেন:
“স্যার, আমি শুধু OCD না। আমি একজন কবিতা ভালোবাসি, আমি ছাত্রদের ভালোবাসি, আমি ভুল করেও শিখি।”
এটাই তাঁর ‘Inner Identity Reconnection’।
Inner Child Therapy
আমি বলি—ছোট SOMEN-এর একটা ছবি নিন। প্রতিদিন তাকে বলুন—
“তুই তোর বাবার রাগ না। তুই তোর ভুল না। তুই আমার SOMEN, আর আমি তোর পাশে আছি।”
এই অনুশীলন তাঁকে কাঁদিয়ে দেয়। সেখানেই শুরু হয় মুক্তির জলধারা।
৮. সমাজের চোখে ‘পাগল’, নিজের চোখে যোদ্ধা
OCD রোগীদের সমাজে এখনো “পাগল” তকমা জুটে।
সোমেন বাবু বলেছিলেন—
“স্কুলের সহকর্মীরা বলে—তুই তো OCD!
যেন এটা একটা ঠাট্টার বিষয়।”
আমি বলি—“একদিন বলবেন—হ্যাঁ, আমি OCD-তে ভুগি, কিন্তু আমি তার সঙ্গে লড়ি।
এটাই তো সাহস।”
৯. রূপান্তরের পথে: ছোট ছোট সেতু, বড় বড় আলো
প্রথম সপ্তাহে দরজা চেক করতেন ৬ বার। এখন ১ বার।
প্রথম সপ্তাহে নিজের নাম বলতে কষ্ট হতো। এখন বলেন—
“আমি SOMEN। আমি মানুষ, আমি ভুল করি, এবং আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।”
তিনি এখন সপ্তাহে একবার শহরের বাইরের কফি শপে যান—ফোন ছাড়া, শুধু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে।
তাঁর স্ত্রীও এখন ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করছেন।
শেষ কথা: আমি নিজেই নিজের পথ
OCD মানুষকে শুধু একই কাজ বারবার করায় না—
এটা মানুষকে নিজের ভেতরের 'আমি'-কে হারিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু থেরাপি, সহানুভূতি ও নিজের কাছে সত্য বলার সাহসে আবার সেই 'আমি' ফিরে আসে।
সোমেন বাবু এখনো তাঁর যাত্রায় আছেন—তবে এখন তিনি জানেন—
“আমি আমার চিন্তা না, আমি আমার অভিজ্ঞতা না।
আমি SOMEN—একটা চলমান, evolving মানুষ।”
✍️ লিখেছেন:
রথীন ঘোষ
ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
Feel Good Now – Ask Me How
📢 [পর্ব ৬ আসছে শীঘ্রই: “সবাই ভালোবাসে, আমি ছাড়া”—আত্ম-তুচ্ছতা ও Relationship Anxiety নিয়ে অর্চনার কাহিনি]
🏷️ #OCDHealing #IdentityCrisis #MentalHealthMatters #SomenCaseFile #MindTherapy #FeelGoodNow #InnerChildHealing
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন