মেনোপজ মানে বিদায় নয়—এ এক নতুন আত্মচেতনার সূচনা
“মেনোপজ মানে বিদায় নয়—এ এক নতুন আত্মচেতনার সূচনা”
নারীর মনের সংকট ও সম্ভাবনার বিশ্লেষণ
লিখেছেন: রথীন ঘোষ, ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
(গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে)
প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ নারী অদৃশ্য এক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যান। বাইরে থেকে কেউ কিছু টের পায় না, অথচ ভিতরে ভিতরে তাঁদের শরীর, মস্তিষ্ক ও আত্মপরিচয়ে ঘটে যায় এক মৌলিক রূপান্তর—এটাই মেনোপজ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO, 2022) তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ৪৭ মিলিয়ন নারী মেনোপজে পৌঁছান। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় ১.২ বিলিয়ন-এ। এত বড় সংখ্যার নারীর মানসিক স্বাস্থ্য আজও সমাজে এক নিস্তব্ধ স্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে আছে।
১. মেনোপজ: শুধুই ঋতুস্রাব বন্ধ নয়
আমরা অনেকেই জানি, মেনোপজ মানে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি শারীরিক ঘটনা নয়—এটি নারীর জীবনের গভীরে পৌঁছনো এক আত্মপরিচয় সংকটের প্রবেশদ্বার।
৩টি ধাপের সংক্ষিপ্তসার:
Perimenopause: অনিয়মিত ঋতুস্রাব শুরু, হরমোন হ্রাসের সূচনা
Menopause: টানা ১২ মাস ঋতুস্রাব না থাকলে নিশ্চিত হয়
Postmenopause: হরমোনের নতুন ভারসাম্যে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক-শারীরিক অভিযোজন
২. জৈবিক অস্থিরতার মানসিক ছায়া
২.১. হরমোনের ওঠানামা:
ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন কমে যাওয়ায় নারীর আবেগ, ঘুম, স্মৃতি, যৌন আকাঙ্ক্ষা এমনকি নিজেকে মূল্যায়নের ক্ষমতাও ব্যাহত হয়।
সিরোটোনিন, ডোপামিন, এবং GABA-এর মত নিউরোট্রান্সমিটারে প্রভাব পড়ে, যার ফলে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মনমরা ভাব প্রায় নিয়মিত অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
২.২. দেহে কী ঘটে:
ওজন বৃদ্ধি, হাড় ক্ষয়
যৌন অঙ্গের শুষ্কতা, যৌন ইচ্ছার অভাব
ঘুমের ব্যাঘাত
রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হৃদ্যন্ত্রের ঝুঁকি
প্রতিটি পরিবর্তন মানসিক ভারসাম্যকে নাড়া দিয়ে যায়—যেমন আপনি প্রতিদিন নিজেকে অচেনা মনে করতে পারেন।
৩. মনস্তাত্ত্বিক ক্ষয়: “আমি আর আগের আমি নই”
৩.১. বিষণ্নতা:
Freeman et al. (2014)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে—মেনোপজকালীন নারীদের ২০-২৫% ক্লিনিক্যাল বিষণ্নতায় ভোগেন।
নারীরা বলেন—
“আমি আগের মতো আকর্ষণীয় নই”,
“আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।”
এটি শুধুই ভাবনা নয়—এই বোধ আত্মার গভীরে আঘাত করে।
ইরিক এরিকসনের “Generativity vs. Stagnation” তত্ত্ব অনুযায়ী, এই সময়ে নারী সমাজের জন্য কিছু করতে চান। কিন্তু যদি সমাজ বা পরিবার তাঁকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে, তবে বিষণ্নতা ও আত্ম-অবসাদ শুরু হয়।
৩.২. উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা:
নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা
যৌন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
“আমি আর মা হতে পারবো না”—এই উপলব্ধি থেকে শূন্যতার সৃষ্টি
৩.৩. আত্মবিশ্বাস হ্রাস:
Albert Bandura বলেছিলেন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুভূতি হারালে মানুষ হাল ছেড়ে দেয়।
মেনোপজ নারীদের অনেকেই বলেন—
“আমার শরীর আমার কথা শুনছে না। আমি যেন নিজের সঙ্গেই এক অজানা লড়াইয়ে আছি।”
৪. সমাজ কি বোঝে নারীর এই পরিবর্তন?
অনেক সমাজে মেনোপজ মানেই “নারীত্বের অবসান”। যেন নারীর মূল পরিচয় শুধুই তার প্রজননক্ষমতা। এর ফল?
উপহাস: “বুড়ি হয়ে গেছো”
যৌন চাহিদার অস্বীকার: “এ বয়সে এসব ভাবা উচিৎ নয়”
অনুভবের অসম্মান: “এসব মনে করে করেই অসুস্থ হচ্ছো”
এইসব মন্তব্য একজন নারীর মানসিক ভিতরটাকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অনেকেই নীরবে ভেঙে পড়েন।
৫. মেনোপজ আসলে কী চায়?—একটি পুনরায় নির্মাণ
Psychodynamic দৃষ্টিভঙ্গি বলে—মেনোপজ হচ্ছে নারীর "নতুন রূপে আত্ম-গঠন" এর সূচনা।
এটি এক ধরণের “psychological rebirth”—যেখানে আগের পরিচয় ভেঙে নতুন পরিচয় তৈরি হয়।
এখন তিনি আর কেবল মা, স্ত্রী, কন্যা নন—তিনি নিজেই নিজের আত্মার শাশ্বত সঙ্গী।
৬. সমাধানের পথ: শরীর, মন ও সমাজ—তিন স্তরের যত্ন
৬.১. জৈবিক সহায়তা:
Hormone Replacement Therapy (HRT): হরমোনের ঘাটতি পূরণ করে আবেগের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়
ভিটামিন D, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট: হাড়ের সুরক্ষায়
চর্ম ও যৌনস্বাস্থ্য চিকিৎসা: শুষ্কতা, যৌন অনীহা দূর করতে সহায়ক
যোগ ও এক্সারসাইজ: মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন বৃদ্ধির জন্য কার্যকর
৬.২. মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি:
CBT: নেতিবাচক চিন্তা চিহ্নিত করে গঠনমূলক চিন্তা গড়ে তোলা
Mindfulness & Meditation: উদ্বেগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
Self-compassion training: নিজেকে দোষ না দিয়ে বুঝে নেওয়া
Support Groups: অন্যদের অভিজ্ঞতা শুনে একাকিত্ব কমে
Couples Counseling: যৌনতা ও আবেগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা
৭. পঞ্চাশ পেরনো মানে উষার আরেক রূপ—'Wise Woman'
নারীর জীবনের এই পর্বে তাঁরা আর “আবেগের শিকার” নন—তাঁরা অভিজ্ঞ, স্থিত, নিজের ভিতরেই শক্তি খুঁজে নিতে পারেন।
সমাজ, পরিবার, এমনকি চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি এই উপলব্ধিকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে নারী এই পর্যায়ে পৌঁছে হয়ে উঠবেন এক "ঐন্দ্রজালিক পরামর্শদাত্রী"—যিনি পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারেন।
৮. মেনোপজে মানসিক সুস্থতার জন্য ৭টি গোল্ডেন কৌশল
✅ নিজেকে বুঝুন—নিজের শরীর, আবেগ ও সীমা
✅ প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন
✅ অনুভূতি শেয়ার করুন পরিবারের সঙ্গে
✅ সময় নিন নিজের জন্য—পছন্দের গান, বই, প্রকৃতির সান্নিধ্য
✅ খোলামেলা আলোচনা করুন যৌনতা নিয়ে
✅ সামাজিক ও সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকুন
✅ প্রয়োজনে ক্লিনিকাল কাউন্সেলিং গ্রহণ করুন
শেষ কথা: এই যাত্রা কষ্টের নয়, যদি আপনি নিজেকে গ্রহণ করতে শেখেন
মেনোপজ একটি অনিবার্য পরিবর্তন—তবে তা ক্ষয় নয়, বরং রূপান্তর।
সমাজ যদি নারীর যন্ত্রণাকে সম্মান দেয়, পরিবার যদি পাশে দাঁড়ায় আর নারী নিজেই যদি নিজের শরীর ও মনের গল্পকে শ্রদ্ধা করতে শেখেন—তবে এই রাত্রি শেষে এক শক্তিময় সকাল অপেক্ষা করছে।
মেনোপজ মানে—আমি শেষ নই। আমি আরেক রূপে শুরু।
লিখেছেন:
রথীন ঘোষ
ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
Feel Good Now – Ask Me How
আপনার মা, দিদি, বন্ধু, সহকর্মী কেউ যদি এই পর্যায়ে থাকেন—তাঁকে পাশে থাকুন। এই লেখা শেয়ার করুন।
#MenopauseAwareness #MentalHealth #WomensWellness #PsychotherapyInBengali
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন