পর্ব ৪: “আমি ভালো আছি—but only on social media”
পর্ব ৪: “আমি ভালো আছি—but only on social media” — ডিজিটাল সত্তা ও বাস্তব জীবনের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে অদিতির দ্বৈতজীবন
লিখেছেন: রথীন ঘোষ, ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
(বাস্তব কেসের উপর ভিত্তি করে রচিত, নাম পরিবর্তিত)
"ফেসবুকে হ্যাপি, ইনস্টাগ্রামে স্মাইলিং... অথচ ভেতরে আমি কাঁদছি।"
এই একটি লাইন দিয়েই অদিতি তাঁর প্রথম সেশন শুরু করেছিলেন।
স্মার্টফোন হাতে রাখা, চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে ফিকে হাসি।
অদিতির বয়স ৩২।
বহুজাতিক কোম্পানিতে মিডিয়া কনসালটেন্ট।
অফিসে তাঁকে সবাই চিনে "এনার্জি বম্ব" বলে—যেকোনো কাজে একশো শতাংশ উজাড় করে দেন।
তবে নিজের জীবনে, নিজের ঘরে, নিজের মনে—সবচেয়ে ফাঁকা তিনি নিজেই।
১. ডিজিটাল মুখোশ: হ্যাশট্যাগ হ্যাপিনেস
“স্যার, আমার ছবি দেখে সবাই ভাবে আমি একদম ঠিক আছি।
ওরা দেখে না রাত ৩টেয় আমি বালিশ ভিজিয়ে ফেলি, দেখেও না আমার ফোনের গ্যালারিতে রয়েছে অসংখ্য মোছা-না-হওয়া ব্রেকআপ চ্যাট।
আমি ভাবি—নিজেকে না হয় ভুলিয়ে রাখি একটা পোস্ট দিয়ে:
#blessedlife।”
এই পরিস্থিতিকে মনস্তত্ত্বে বলা হয় “Digital Self vs. True Self Dissociation”।
অদিতি নিজের আসল কষ্টগুলোকে সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ দিয়ে ঢেকে রাখতে শিখে ফেলেছেন।
তবে সেটা যে ধীরে ধীরে তাঁকে নিঃসঙ্গ করে তুলছে—সেই সত্যটা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
২. ফলোয়ার, না ফাঁকা: একা এক পৃথিবী
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি— “আপনার ইনস্টাগ্রামে প্রায় দশ হাজার ফলোয়ার। কিন্তু সত্যিকারের বন্ধুর সংখ্যা কয়জন?” তিনি থেমে বলেন— “হয়তো একজনও না।
জীবনে কোনো একসময় এমন হয় যখন চারপাশ ভরপুর, কিন্তু মন—একেবারে খালি।”
এখানেই আমরা চিহ্নিত করি “Emotional Disconnect Syndrome”।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যত ‘রিয়েল-টাইম কানেকশন’ থাকুক, হৃদয়ের বাস্তব কানেকশন তখনও শূন্য।
৩. কোথা থেকে এল এই অভ্যাস?
সেশনের চতুর্থ দিন, আমরা ব্যবহার করি Trauma Timeline Recall।
তিনি বলেন— “আমি ছোটবেলায় খুব একা ছিলাম।
মা-বাবা দুজনেই কর্মজীবী, আমি সারাদিন টিভি দেখতাম।
বন্ধু বলতে মোবাইল আর কল্পনার বন্ধু।
একদিন বুঝলাম—‘নিজের অনুভূতি কাউকে বললে বোঝে না’। তখন থেকেই একটা 'ছবির মতো জীবন' বানাতে শুরু করলাম।"
এই 'ছবি'ই এখন তাঁর ফাঁদ।
৪. থেরাপির পথ: নকল আলো থেকে বাস্তব ছায়ার দিকে
CBT (Cognitive Behavioral Therapy)
তিনি যেসব চিন্তা করেন, সেগুলো চিহ্নিত করি—
“আমি একা থাকলে দুর্বল দেখাব।”
“ভালোবাসা মানে পরাধীনতা।”
এগুলোকে Reality Testing-এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে বদলানো শুরু করি।
Mirror Talk Therapy
তাঁকে বলি, প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন:
“আমি যেমন, ঠিক তেমন আমি গ্রহণযোগ্য। আমাকে ভালোবাসা যায়।”
Digital Detox & Reality Dates
আমরা ঠিক করি—
প্রতি শুক্রবার ফোন বন্ধ রেখে “Reality Date”—নিজের জন্য এক ঘণ্টা প্রকৃতির মাঝে বা পছন্দের কফি শপে সময় কাটানো।
একটি offline বন্ধুকে সপ্তাহে একবার কল করা, গল্প করা।
Gratitude & Grounding Exercise
প্রতিদিন লিখতেন: "আজকে আমি কি অনুভব করলাম?"
মাটি ছুঁয়ে ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতেন।
৫. রূপান্তর: ইনস্টাগ্রামের বাইরেও জীবন
ছয় সপ্তাহ পরে অদিতি বলেন— “স্যার, আজ একটা ছবি পোস্ট করিনি।
কিন্তু বিকেলটা কাটালাম আমার ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে।
আমরা দু’জনে মিলে শুধু হেসেছি।
কোনো ছবির দরকার পড়েনি।”
এই “ছবিহীন মুহূর্ত”ই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বাস্তব মুহূর্ত।
শেষ কথা: আমরা সবাই কিছু না কিছু ঢাকি
প্রযুক্তির এই যুগে নিজের আসল অনুভূতি প্রকাশ করাটা যেন লজ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ, সত্যিটা হলো—ভালো থাকা মানেই সবসময় হেসে থাকা নয়।
ভালো থাকা মানে—নিজেকে বোঝা, নিজের কষ্টকে স্থান দেওয়া, আর মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরে গিয়ে, শুধু নিজের সঙ্গে একটু সময় কাটানো।
ভালোবাসুন নিজেকে—ছবির জন্য নয়, জীবনের জন্য।
লিখেছেন:
রথীন ঘোষ
ক্লিনিকাল সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
Feel Good Now – Ask Me How
#SocialMediaTrauma #DigitalMask #MentalHealthAwareness #AditiCaseFile #InnerHealing
[পর্ব ৫: “আমার মধ্যেই আমি হারিয়ে যাই”—OCD ও identity crisis নিয়ে এক শিক্ষকের আত্মসংগ্রাম, শিগগির আসছে]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন